আবেদ আলি ও কর্ম্মচারীদ্বয় জেলা হইতে বাহির হইয়া যাইবার পর জেলার সর্ব্বপ্রধান পুলিস-কর্ম্মচারী ও সর্ব্বপ্রধান বিচারক সাহেব সমস্তই প্রস্তুত করিয়া রাখিলেন; সংবাদ পাইবামাত্র তাঁহারা স্বদলবলে গমন করিতে পারিবেন, কালমাত্র বিলম্ব হইবে না, এরূপ সমস্তই ঠিক রহিল ও ইহাও স্থির রহিল যে, তাঁহারা নিজেই ঐ কার্য্যে গমন করিবেন।

 জেলার সমস্ত কর্ম্মচারীই বুঝিতে পারিল যে, কি একটা ঘটিবে, বোধ হয়, কোন স্থানে দাঙ্গা হইবার সম্ভাবনা আছে, তাই সিপাহি শান্ত্রী সর্ব্বদা প্রস্তুত থাকে। কিন্তু কেন যে প্রস্তুত থাকে, তাহা সঠিক কেহই অবগত নহে; যাহারা প্রস্তুত থাকে, তাহারাও বলিতে পারে না কি কার্য্যে কোথায় গমন করিতে হইবে?

 এইরূপে প্রায় ১০ দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এদিকে সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীয় আপনারা দলবলের সহিত সশস্ত্রে প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। অপর দিকে আবেদ আলি সমভিব্যাহারী কর্মচারীদ্বয় ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরিতে লাগিল।

 একাদশ দিবসের দিন আবেদ আলি আসিয়া সেই কর্ম্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিল যে, আগামী কল্য স্থির হইবে যে, কোন্ গ্রামে ও কাহার বাড়ীতে ডাকাইতে হইবে। পর দিবস রাত্রি নয়টার সময় আসিয়া পুনরায় সংবাদ প্রদান করিল যে, সেই রাত্রেই বারটার পর উহারা ডাকাইতি করিবে। যে গ্রামে ডাকাইতি হইবে, সেই গ্রামের নামও বলিয়া দিল, কিন্তু কাহার বাড়ীতে যে ডাকাইতি হইবে, তাহা বলিতে পারিল না। কারণ যাহার বাড়ীতে ডাকাতি হইবে, সংবাদদাতা তাহার নাম বলে নাই, সে সঙ্গে গিয়া ঐ বাড়ী দেখাইয়া দিবে।

 এই সংবাদ প্রদান করিয়াই আবেদ আলি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল।

 যেস্থানে ডাকাইতি হইবে, সেই স্থান ঐ স্থান হইতে প্রায় পাঁচক্রোশ ও সেই স্থান হইতে জেলাও প্রায় পাঁচক্রোশ দূরে। সংবাদপ্রাপ্তির স্থান হইতে জেলাও ৭ ক্রোশের কম নহে। এখন ৭ ক্রোশ পথ গমন করিলে, জেলায় সংবাদ পৌঁছিবে। সেই স্থান হইতে পাঁচক্রোশ পথ গমন করিলে, যে গ্রামে ডাকাইতি হইবে, সেই গ্রামে উপস্থিত হইতে পারা যাইবে। এদিকে সময় ৩ ঘণ্টা মাত্র। এত অল্প সময়ের মধ্যে কর্ম্মচারীগণ সেই স্থানে উপস্থিত হইতে পারিবেন কি না, বলা যায় না। যাহা হউক, ঐ কর্ম্মচারী সেই অশ্বারোহীকে তখনই সংবাদ প্রদান করিলেন, তিনি দ্রুতবেগে অশ্ব চালনা করিয়া কোন গতিকে রাত্রি ১২ টার সময় জেলায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলেন। এদিকে কর্ম্মচারীও যে গ্রামে ডাকাইতি হইবার কথা, সেই গ্রামভিমুখে গমন করিলেন।

 জেলায় কর্ম্মচারীগণও প্রস্তুত ছিলেন, তাঁহারাও সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র অশ্বারোহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। অপর যে কয়েকজন অশ্বারোহী পুলিস ছিল, তাহারাও তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতে লাগিলেন। ঐ দলের নেতা, যিনি সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও তাঁহার অশ্ব পরিত্যাগ করিয়া অপর আর একটী অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক তাহাদিগের সহিত গমন করিলেন। এইরূপে অশ্বারোহীর সংখ্যা দশ জনের অধিক হইল না। অপরাপর কর্ম্মচারীগণ প্রায় একশত অস্ত্রধারী পুলিশ প্রহরী সমভিব্যাহারে পদব্রজে তাঁহাদিগের অনুসরণ করিলেন। কিন্তু অশ্বারোহীগণের সহিত একত্রে গমন করিতে পারিলেন না, তাহাদিগের অনেক পশ্চাতে পড়িলেন।

 সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীদ্বয় অস্ত্রধারী অশ্বারোহীর সহিত যখন সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন ডাকাইতি প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে, অথচ তাঁহাদিগের অনুচরগণ তখনও পর্য্যন্ত উপস্থিত হইতে পারেন নাই। জেলার দুইজন প্রধান ইংরাজ কর্ম্মচারী যখন ডাকাইতির সময় সেই স্থানে গিয়া, উপস্থিত হইলেন, তখন তাঁহাদিগের সাহায্যকারী নিতান্ত অল্প হইলেও তাঁহারা স্থির থাকিবার লোক নহেন। এইরূপ অবস্থায় যদি কেবল একজন ইংরাজ কর্ম্মচারীও বিনা সাহায্যে আসিয়া উপস্থিত হইতেন, তিনিও চক্ষের উপর উহা দেখিতে পারিতেন না। ইংরাজের স্বভাব সেরূপ নহে। এ ক্ষেত্রে দুইজন প্রধান ইংরাজ কর্ম্মচারী দশজন সশস্ত্র অনুচরের সহিত উপস্থিত। ডাকাইতের সংখ্যা যতই হউক না কেন, আপন প্রাণের উপর মায়া করিয়া তাঁহারা কখনই স্থির থাকিতে পারেন না।

 ইংরাজ কর্ম্মচারীদ্বয় ঐ দশজন অনুচর লইয়াই উহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। অন্য আক্রমণ নহে, উহাদিগকে একেবারে গুলি করিতে আদেশ দিলেন। একেবারে দ্বাদশ বন্দুকের আওয়াজ হইল। ডাকাইত দলের মধ্য হইতেও বন্দুকের শব্দ হইতে লাগিল। বন্দুকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ডাকাইতগণ তাহাদিগের মশাল প্রভৃতি যে সকল আলো ছিল, তাহা একেবারে হঠাৎ নির্ব্বাপিত করিয়া দিল। সুতরাং সেই স্থান একবারে অন্ধকারময় হইয়া পড়িল; গুলি সকল সন্ সন্ শব্দে ছুটিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, সেই স্থান একেবারে জনশূন্য, অন্ধকারের আশ্রয় লইয়া ডাকাইতগণ পলায়ন করিয়াছে।

 পরে জানিতে পারা গিয়াছিল, আবেদ আলিও ঐ ডাকাইতদিগের সঙ্গে আগমন করিয়াছিল। সে জানিত যে, ডাকাইতি করিবার সময় গোলযোগ হইবে, সুতরাং সে বাড়ীর ভিতরে না গিয়া বাহিরে ঘাঁটি আগলাইতে লাগিল। অশ্বারোহীগণকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া সাঙ্কেতিক শব্দে উহাদিগকে সংবাদ দিয়া আবেদ নিজের কার্য্য শেষ করে ও তথা হইতে প্রস্থান করে।

 ডাকাইতগণ প্রস্থান করিবার পর আলো জ্বালাইয়া ঘটনা স্থল উত্তমরূপে পরীক্ষা করিবার সময় পূর্ব্ব-কথিত সংবাদ সংগ্রহকারী কর্ম্মচারীও সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘটনাস্থলে অনুসন্ধান করিয়া দুইটী মৃতদেহ পাওয়া গেল। বন্দুকের গুলি উহাদিগের বক্ষঃস্থল ভেদ করায় তাহাদিগের মৃত্যু হইয়াছে। যাহাদিগের মৃতদেহ পাওয়া গেল, তাহারা ঐ গ্রামের লোক নহে, বা ঐ গ্রামের কোন লোকও তাহাদিগকে চিনিতে পারিল না। সুতরাং ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, ঐ দুই ব্যক্তি ডাকাইতের দলের লোক; পুলিসের গুলিতে মরিয়া গিয়াছে।

 ডাকাইত দলের মধ্যে হইতে যে সকল গুলি ছুড়িয়াছিল, তাহাতে পুলিসের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নাই, কেবলমাত্র একটী অশ্ব সামান্যরূপ আহত হয়। পদাতিক কর্ম্মচারীগণ যখন আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন সমস্তই শেষ হইয়া গিয়াছিল।

 ডাকাইতগণ অন্ধকারের আশ্রয়ে সেই স্থান হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং কোন্ দিকে ও কিরূপ অবস্থায় তাহারা প্রস্থান করিয়াছিল তাহা জানিতে না পারায় অশ্বারোহীগণ তাহাদিগের অনুসরণ পর্য্যন্ত করিতে সমর্থ হয় নাই।

 এইরূপে বিফল মনোরথ হইয়া ইংরাজ প্রধান কর্ম্মচারীদ্বয় নিতান্ত ক্ষুব্ধ মনে আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন।

 সময় মত আবেদ আলি আসিয়া সেই কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিল ও যেরূপে তাহারা ঐ ডাকাইতি করিয়া পলায়ন করিয়াছিল, তাহার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট বিবৃত করিল। আরও কহিল যে, সেই ভূত, এবারও দলপতি হইয়া ঐ ডাকাইতি করিতে গমন করিয়াছিল। কিন্তু আক্রান্ত হইয়া সকলে যখন পলায়ন করিয়াছিল, সেই সময় হইতে ঐ দলপতিকে আর কেহই দেখিতে পায় নাই। ডাকাইতি করিয়া যে সকল দ্রব্যাদি আনা হইয়াছিল, তাহা ডাকাইতির চারি দিবস পরে সকলের মধ্যে বিভাগিত হয়। সেই সময়েও দলপতি সেই স্থানে উপস্থিত হয় নাই। অপরাপর ডাকাইতগণ তাহাদিগের আপনাপন অংশ গ্রহণ করিয়া চলিয়া যায়; দলপতির অংশ একজনের নিকট গচ্ছিত থাকে।

 আবেদ আলি এই সকল বিষয় কর্ম্মচারীকে বলিয়া তাহার অংশে সে সকল দ্রব্যাদি পাইয়াছিল, তাহা অনিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিল। আর ঐ ডাকাইত দলের যে সকল ব্যক্তির নাম ও বাসস্থান এ পর্য্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছিল, তাহারও একটী তালিকা তাঁহাকে প্রদান করিল।

Please join our telegram group for more such stories and updates.telegram channel